চলতি মাসেই বাড়তে পারে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:০৫ এএম, ১৮ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:২২ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ডিজেল, কেরোসিন ও এলপি গ্যাসের পর এবার গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উচ্চমূল্য থাকায় দেশের বাজারে তা সমন্বয় করতে এ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এ খসড়া চূড়ান্ত হওয়া সাপেক্ষে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে চলতি মাসেই। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ঠিক কী পরিমাণে বাড়ানো হবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাব্য হারের ওপর।
জানা যায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলনের পাশাপাশি আমদানীকৃত এলএনজিও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ক্রমেই বেড়েছে। যদিও জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিক্রি করছে আগের মূল্যেই। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে সরকারকে। এ অবস্থায় দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জ্বালানি বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোভিড মহামারির আগে স্বাভাবিক অবস্থায় এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে খরচ হতো ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি টাকার মতো। বর্তমানে একই পরিমাণ এলএনজিবাহী কার্গো আমদানিতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বর্তমানে দেশে এলএনজি আনতে হচ্ছে আগের চেয়ে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি দামে। জ্বালানি পণ্য আমদানিতে গত এক বছরের ব্যয় বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, এতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি।
সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানিতে সরকারের খরচ হচ্ছে ২৮-৩০ ডলারের মতো। সে হিসাবে চলতি বছর জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে ভর্তুকি হিসাবে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। বর্ধিত এ আমদানি খরচ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন জ্বালানি বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে, তা বহন করার মতো সাধ্য পেট্রোবাংলার নেই। ফলে অর্থের জোগান নিশ্চিতের পাশাপাশি ভর্তুকি কমাতে মূল্য সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই।
অন্যদিকে দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তার প্রভাব পড়বে বিদ্যুতেও। দেশে সরবরাহকৃত মোট গ্যাসের বড় একটি অংশ যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। পিডিবি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে অন্তত ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। গ্যাস সংকটে বর্তমানে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পিডিবি চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি হিসেবে ১৬ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে। তবে কমছে গ্যাস উৎপাদন। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি কমেছে। এ অবস্থায় শীতে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বাড়তি চাহিদা মেটানোর মতো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ফলে বর্তমান শীত মৌসুমে তীব্র গ্যাস সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
গত ৭ মাসেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কিনতে গিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে সরকার। এরই মধ্যে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দামের বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে ক্ষতির মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বাজারে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। আর গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, শীতের সময় এমনিতেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। তাতে সরবরাহ লাইনে গ্যাস বাড়িয়ে চাপ বাড়াতে হয়। না হলে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া শীতে গ্যাসের বাড়তি চাহিদাও তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন গড়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের (এমএমসিএফডি) চাহিদা থাকে ৩ হাজার ঘনফুট। শীতকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ ঘনফুটে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে চাহিদা বাড়ে ১২০০ ঘনফুট। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ চাহিদা বাড়ে শীতে।
বর্তমানে দেশে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন ২ হাজার ৯০০ ঘনফুটের মতো। ঘাটতি রয়েছে ১৩০০ ঘনফুট। ঘাটতি ৩১ শতাংশ। চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান দিতে হলে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি করতে পারছে না। এখন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি দেয়া হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে না। বিদ্যমান ফিল্ডগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন কমছে। ফলে ক্রমান্বয়ে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে দেশ। অর্থাৎ বিদেশ থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় বাজারেও প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুকেন্দ্রে অন্তত এক হাজার ৪০০ এমএমসিএফডি (প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) গ্যাসের প্রয়োজন হয়। গ্যাস সংকটে বর্তমানে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এই দুই জ্বালানির দাম বাড়ায় তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ আরো বেড়েছে। এ অবস্থায় পিডিবি’র চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, এলএনজি আমদানিতে যে পরিমাণ খরচ তা মেটানোর মতো যথেষ্ট সামর্থ্য পেট্রোবাংলার নেই। আগামী মাসে এক জাহাজ এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হবে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পেট্রোবাংলার পক্ষে জোগাড় করা কষ্টসাধ্য।