তেলের দাম বাড়ানোর ফলে বিপাকে সাধারণ মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২২ এএম, ১৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:০৯ এএম, ৯ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির পর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর গণপরিবহনে ভাড়া বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ এই তেলের মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা করছেন ভোক্তা এবং অর্থনীতিবিদরা।
করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এমন সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না ভোক্তারা। অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি অযৌক্তিক।
গণপরিবহনে খরচ বৃদ্ধি : তেলের মূল্য বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। যোগাযোগ খাতে ডিজেলের চাহিদা ৬৪ শতাংশের মতো। সরকারি ঘোষণায় ২৩ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির সাথে গণপরিবহনে ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহনে ভাড়া বেশি আদায় হচ্ছে বলেই অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি, তেলের দামের কারণে ভাড়া বৃদ্ধির ফলে বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পরিবহন ভাড়া হিসাব করে সংগঠনটি বলছে, দৈনিক ২৫-৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় হচ্ছে এই পথে।
রাজধানীতে একজন যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘আমাদের পকেট থেকে টাকাটা বেরিয়ে যাচ্ছে না। যে টাকাটা আপনি হয়তো জমা করতাম, সে টাকাটা জমা করতে পারছি না। এখন তো জমা করার কোনো সুযোগই নেই।’
কৃষি খাতে ডিজেলের চাহিদা মোট ডিজেল আমদানির ১৮ শতাংশ। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল এই সময়টিতেই ডিজেলের চাহিদা চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় আবাদ হয় এই বোরো মৌসুমে। কৃষকরা বলছেন, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বোরো চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
মুন্সীগঞ্জের একজন কৃষক কামাল তালুকদার বলছিলেন, সামনে বোরো মৌসুমে চাষের খরচ বৃদ্ধি নিয়ে কৃষকরা এখন হতাশ। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ডিজেলের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই উচিত হয়নি। ‘হঠাৎ করে পনেরো টাকা লিটারে বাইড়া গেলগা! এই টাকাটা কোথা থাইকা দিব? আমাগো খুব ক্ষতি হইছে। কৃষি আর কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ কিন্তু সরকার কৃষকদের দিকটা দেখলো না।’
হাবিব নামে আরেকজন কৃষক বলেন, কৃষি যন্ত্রের সবই চলে ডিজেলে। তেলের অতিরিক্ত দাম খরচ বাড়াবে জমি চাষ, সেচ থেকে ধান কাটা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই।
‘একবারে ১৫ টাকা বাড়াইছে, আপনার সবার বিবেকে নাড়া দিয়ে দিছে। এই সরকার চাচ্ছে কী? এই সরকার কি জনগণের সরকার না? এই সরকার কি কৃষকের সরকার না?’
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি : নিত্যপণ্যের বাজারেও তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। পণ্য পরিবহনের বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের দামের সাথে। নিয়মিত বাজার করা দেলোয়ারা খাতুন বলছিলেন, ‘সবদিকে খরচ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট আরো বাড়লো।’
‘তরি-তরকারি, চাইল ডাইল সবকিছুর উপরে দাম বাড়ায় দিছে এই তেলের দাম বাড়ানোর জন্য। এমনিই করোনার মানুষ সমস্যায় আছে। সাধারণ মানুষ মধ্যবিত্ত মানুষের বেহাল অবস্থা।’ তেলের দাম বৃদ্ধির এই প্রভাবে সবচেয়ে সংকটে পড়বে সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। ন্যায্যমূল্যের পণ্যের জন্য ক্রেতাদের লাইনও তাই দীর্ঘ হচ্ছে।
শিল্প-কারখানার ওপর প্রভাব : এদিকে ২৩ শতাংশ তেলের দাম বৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়বে শিল্প-কারখানার উৎপাদন খরচে। তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, তেলের বাড়তি দামের কারণে ১ শতাংশ উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে তাদের।
বাংলাদেশে মোট তেল আমদানির ৭৩ শতাংশই ডিজেল। জ্বালানি বিভাগের তথ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করায় গত ৫ মাসে ১১শ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা : সরকারের দাবি, আন্তর্জাতিক দরের সাথে সমন্বয় করে দাম না বাড়ালে দৈনিক ২০ কোটি টাকা লোকসান হবে। জ্বালানি বিভাগের সচিব আনিসুর রহমান বলেন, ‘অক্টোবরে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছিল। এবং তাতে মাসে ৬শ কোটি বা তারও অধিক।’
‘এই মুহূর্তে বিপিসি’র হাতে আর অন্য কোনো অস্ত্র ছিল না দাম বাড়ানো ছাড়া। কারণ আমরা ভর্তুকি পাওয়া যাবে নাÑ এরকম একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।’
তিনি জানান, ‘জানুয়ারি মাসের যে শিডিউল আছে, তখনকার জন্য যদি আমরা তেল আমদানি করতে চাই তাহলে এই বৃদ্ধি যদি না হতো তাহলে কিন্তু এলসি ওপেন করা কঠিন হয়ে যেতো।’
অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির হিসাবে, গত ৭ বছর ধরে তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় তেলের দাম কমানো হয়নি। এছাড়া প্রতি লিটার ডিজেল আমদানিতে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ ১৯ টাকা আদায় করে। শুল্ক হ্রাস করেও লোকসান কমানো যেত।
আয়-ব্যয় আর অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে এই মুহূর্তে ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির কোনো যুক্তি দেখেন না ভোক্তা এবং অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র : বিবিসি