চট্টগ্রাম জিপিওতে ভুয়া একাউন্ট খুলে লোপাট ৩০ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩৭ এএম, ২৩ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১২:২৬ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
চট্টগ্রাম জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস)। সরকারি ডাক বিভাগে সঞ্চয় রয়েছে হাজার হাজার নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে অসংখ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-কর্মকর্তা কর্মচারীর। ডাক বিভাগে সঞ্চয় রেখে মুনাফা থেকে সংসার চালান এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। অনেকের সারা জীবনের সঞ্চয়ও রাখা হয় পোস্ট অফিসে। সেখানে হাত পড়েছে জালিয়াত চক্রের। এ চক্রে রয়েছেন খোদ পোস্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এ ধরনের একটি চক্র গত পাঁচ বছরে লোপাট করেছে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম জিপিওতে তিন গ্রাহকের ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের হওয়া একটি মামলা তদন্তে নেমে চক্রটির সন্ধান পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জিপিএ’র টাকা লোপাট চক্রে ১২ জনের অধিককে চিহ্নিত করে দুদক। ইতিমধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। লোপাটকৃত অর্থের গন্তব্য চিহ্নিত করতেও কাজ করছে দুদক।
জানা যায়, গত বছরের ২১ অক্টোবর দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয় ১-এ মামলাটি দায়ের করেন ওই কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম মোড়ল। এই ঘটনায় এর আগে জড়িত দুই কর্মকর্তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে ডাক বিভাগ। তারা হলেন- চট্টগ্রাম জিপিও’র সহকারী পোস্টমাস্টার নূর মোহাম্মদ (৫৪) ও পোস্টাল অপারেটর সরওয়ার আলম খান (৫২)। নূর মোহাম্মদ বোয়ালখালী থানাধীন খরণদ্বীপ গ্রামের মৃত দলিলুর রহমানের ছেলে এবং সরওয়ার আলম লোহাগাড়া থানাধীন বড়হাতিয়া গ্রামের আইয়ুব খানের ছেলে। অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলায় এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, নূর মোহাম্মদ ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম জিপিও’র সঞ্চয় শাখায় সহকারী পোস্টমাস্টার হিসেবে এবং ২নং আসামি সরওয়ার আলম খান চলতি বছরের ১ মার্চ হতে সঞ্চয় কাউন্টার ১-এ পোস্টাল অপারেটর হিসেবে কর্মরত আছেন।
গত বছরের ২৬ আগস্ট বিকালে চট্টগ্রাম জিপিও’র ঊর্ধ্বতন পোস্টমাস্টার ড. মো. নিজাম উদ্দিন সঞ্চয় শাখা আকস্মিক পরিদর্শন করেন। পরিদর্শকে রায়ফা হোসেন, লাকী আক্তার ও সাকি আক্তার নামের তিন আমানতকারীর হিসাবের লেজারে জমা দেখালেও ওই টাকা সরকারি খাতে জমা না করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ৪৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের প্রমাণ পান তিনি। তিন গ্রাহকের মধ্যে রায়ফা হোসেনের ১৬ লাখ, লাকী আক্তারের ১৪ লাখ এবং সাকি আক্তারের ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন জিপিও’র সহকারী পোস্টমাস্টার নূর মোহাম্মদ ও পোস্টাল অপারেটর সরওয়ার আলম খান। ওই রাতেই তাদের কোতোয়ালি থানায় সোপর্দ করা হয়। থানায় তাদের বিরুদ্ধে লিখিত এজাহার দেয়া হয়। ঘটনার অপরাধ দুদক আইনের সিডিউলভুক্ত হওয়ার কারণে থানাপুলিশ অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে এন্ট্রি করে এজাহারটি দুদকে প্রেরণ করে।
থানায় সোপর্দ করার পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে আটক হওয়া দুই কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নূর মোহাম্মদের টেবিলের পুরাতন ড্রয়ার থেকে নগদ ২০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা এবং বাথরুমের পার্শ্ববর্তী সানসেটের উপর হতে নগদ ৫৬ হাজার টাকাসহ মোট ২১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে মামলাটি তদন্তে নেমে দুদক জানতে পারে, একজনের ছবি, আরেকজনের তথ্য দিয়ে জিপিওতে খোলা হয় সঞ্চয়ী হিসাব। এ ধরনের ১০টি হিসাবের হদিস মিলেছে দুদকের তদন্তে। অর্থ লোপাটের জন্য যাদের নামে হিসাব খোলা হয়েছে তাদের অনেকেই বিষয়টি জানতেন না। তবে পুরো চক্রটিকে শনাক্তের পাশাপাশি লোপাট হওয়া অর্থ কোথায়, কার কাছে রয়েছে সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দুদক। ৯ মাসের তদন্ত কাজে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি টাকার মতো লোপাটের হদিস মিলেছে।
দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয় ১-এর উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন বলেন, চট্টগ্রাম জিপিওতে ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্তে অনেক তথ্য উঠে এসেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে জিপিও’র টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত অনেককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এখনো তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। জিপিও থেকে লোপাট হওয়া টাকা কোথায়, কোন হিসাবে গেছে, তারও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত কত টাকা লোপাট হওয়ার তথ্য মিলেছে সে বিষয় নিশ্চিত করতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম জিপিওতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মতো লোপাট হওয়ার তথ্য মিলেছে। এখানে কর্মকর্তা, কর্মচারী বাদেও পুরো একটি চক্র জড়িত। তাদের বেশিরভাগকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, জালিয়াত চক্র একজনের ছবির সাথে আরেকজনের তথ্য দিয়ে জিপিও হিসাব খুলেছে। এসব হিসাবে টাকা ট্রান্সফার করে উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। পুরো চক্রটির নেতৃত্বে ছিলেন জিপিও গ্রেফতার হওয়া দুই কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিনি আরও বলেন, ডাক বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তারা আত্মসাৎ না করলেও তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। বেশি টাকা লেনদেন হয় এমন হিসাবগুলো সময়ে সময়ে যাচাই করা হয়নি। বড় অংকের টাকা নগদায়নের ক্ষেত্রে সতর্কতা নেয়া হয়নি। ৩-৪ বছর ধরে ঘটনাগুলো ঘটেছে। শুরু থেকেই ডাক বিভাগের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগও এর দায় এড়াতে পারবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে জানান তিনি।