বিতর্কিত প্রিয়া সাহার এনজিও শারি সংস্থায় চলছে দুর্নীতির মহোৎসব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩২ পিএম, ৬ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫১ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সম্পর্কে নালিশ প্রদানকারী সেই বিতর্কিত প্রিয় বালা বিশ্বাস ওরফে প্রিয়া সাহার নিয়ন্ত্রনাধীন এনজিও প্রতিষ্ঠান শারিতে এখন চলছে লুটপাটের মহোৎসব।
যাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, তারা নিজেরা এবং সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে জার্মান থেকে সাহায্য প্রদানকারী দুটি দাতা সংস্থা যথাক্রমে ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড এবং মিজেরিয়র জার্মান এর কোটি কোটি টাকা এখন সংস্থার দু-একজনের সহায়তায় অর্থ সমন্বয়কারী প্রদীপ চন্দ্র দাস হাতিয়ে নিচ্ছেন।
পাশাপাশি প্রতিদিন অফিস শুরুর পূর্বেই প্রিয়া সাহা তার একান্ত কাছের ব্যাক্তিদের নিয়ে জুম মিটিং করে বিগত দিনের হিসাব নিকাশ নিচ্ছেন। অথচঃ সংস্থার শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বিগত ৪ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত বেতন বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
দেশের দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী সংস্থা শারি’র কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্তমানে সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক এবং ডেসটিনির সাবেক কর্মকর্তা শক্তিময়ী হীরার একগুয়েমীপনা, সংস্থাকে নিজের সম্পদ মনে করা এবং অর্থ আত্মসাতের হীণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় এবং তাকে এই সকল কাজে সহায়তাকারী সংস্থার অর্থ সমন্বয়কারী প্রদীপ চন্দ্র দাসের অর্থ তছরুপের কারণে মাসের পর মাস বেতন বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে শারি’র শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই শারি সংস্থার তৎকালীন নির্বাহী প্রধান প্রিয়া সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোলাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ বিরোধী নালিশ করার পর থেকে আর দেশে আসতে পারেননি। তার অবর্তমানে সংস্থার হাল ধরেন তথাকথিত কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ৮৬ বছরের ড. এম গুল হোসাইন। যিনি শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রধান বনে যান। তাঁকে সমানে রেখে সংস্থার অর্থ বিভাগের প্রধান প্রদীপ দাস অর্থের যাবতীয় দায়িত্ব হাতে নেন।
এরই অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন সময় আসা অনুদান থেকে বেশির ভাগ টাকাই ব্যাক্তিগত হিসাবে সরিয়ে ফেলেন। এমনকি এর একটা বিরাট অংশ আমেরিকায় প্রিয়া সাহার কাছেও পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। এদিকে এই অনভিপ্রেত কাজ কর্ম চালানোর ফলে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে সংস্থার অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতন বঞ্চিত হয়ে পড়ে। সংস্থার জন্য প্রাপ্ত অনুদান হাতে পাওয়া যায়নি, অনুদান আসলেও ব্যাংকে জমা হয়নি, এনজিও ব্যুরো অর্থ ছাড়ের অনুমাদন দেয়নি ইত্যাদি অজুহাতে কর্মীদের বঞ্চিত রাখা হচ্ছে।
ফলে এই সংস্থার শতাধিক কর্মী মানবেতর জীবন যাপন করছে। পরবর্তী সময় বৃদ্ধ ড. গুল হোসেনকে দিয়ে যখন নিজেদের কাজ হাসিল করা সম্ভব হচ্ছিল না, ঠিক সেই মুহুর্তে কোন কারন দর্শানো ছাড়াই তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে প্রিয়া সাহার আপন বড় ভাই সাবেক উপ সচিব জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী এবং ডেসটিনিতে কর্মরত শক্তিময়ী হীরাকে সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক বানানো হয়। যদিও সংস্থার সকল কার্যক্রম চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে আত্মগোপনে থাকা প্রিয়া সাহার নির্দেশনা অনুযায়ীই।
এদিকে সারা বিশ্বে করোনা শুরু হওয়ার পরে যখন মাঠ পর্যায়ে কোন কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, ঠিক তখনই ত্রাণ সহযোগিতা দেয়ার চিন্তা চেতনা থেকে জার্মানভিত্তিক দাতা সংস্থা মিজেরিয়র জার্মান এবং ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড শারি’র কর্ম এলাকা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং ঢাকা জেলায় ত্রাণ সহযোগিতার জন্য শারিকে অর্থ পাঠায়। মিজেরিয়র জার্মানের দেয়া ৪২ লাখ এবং ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ডের দেয়া ৩৬ লাখ টাকা, যা মাঠ পর্যায়ে কোন উপকারভোগীর হাতেই পৌঁছায়নি।
জানা গেছে, সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক শক্তিময়ী হীরা এবং অর্থ সমন্বয়কারী প্রদীপ চন্দ্র দাস এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সেই অর্থ পুরোটাই আত্মসাত করা হয়েছে। আরও জানা গেছে, মিজেরিয়র জার্মান থেকে আসা ৪২ লাখ টাকা সংস্থার তৎকালীন নির্বাহী প্রধান প্রিয়বালা বিশ্বাসের ছোট বোন প্রীতিলতা বিশ্বাস এবং শক্তিময়ী হীরার যোগসাজশে গত ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সোনালী ব্যাংক, ঝিকাতলা শাখায় ৫টি চেকের মাধ্যমে এবং ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ডের ৩৬ লাখ টাকা ৪টি চেকের মাধ্যমে গত মার্চ মাসে উত্তোলন করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, যে প্রতিষ্ঠানের নামে ত্রাণের মালামাল ক্রয় করার জন্য চেক প্রদান করা হয়েছে, মূলতঃ সেই প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল ক্রয় না দেখিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি দোকান দেখানো হয়েছে। আসলে সেখান থেকেও কোন কিছুই কেনা কাটা হয়নি। এই দুটি প্রকল্পের ত্রাণ এর অর্থ দিয়ে ৭টি জেলার ২৫০০ জনকে সহযোগিতা করা হয়েছে দেখানো হলেও কোন সহযোগিতা পায়নি একজনও।
সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করা হয়েছে মার্চ, ২০২১ এ। এই একমাসে সংস্থা প্রায় এক কোটি টাকার কাজ করেছে দেখিয়ে বিল ভাউচার তৈরি করেছে। আসলে হয় নাই কোন কাজই। পাশাপাশি করোনাকালীন এই সময়ে এক মাসে এক কোটি টাকার কাজ করা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে আরও জানা গেছে, ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস পালনের জন্য দাতা সংস্থা থেকে প্রতি জেলার জন্য ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্প সমন্বয়কারী অর্থ বিভাগের সহায়তায় মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে বাকী টাকার পুরোটাই আত্মসাত করেছে। চলতি বছরও একই কায়দায় আত্মসাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এ সকল বিষয়ে প্রতিবাদ করায় সংস্থার প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী জগদীশ চন্দ্র সানাকে চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সংস্থার উপ নির্বাহী পরিচালক রবীন্দ্র লাল বড়ুয়াকে নির্বাহী পরিচালক করার কথা থাকলেও আত্মসাতের কাজকর্মে রাজী না হওয়ায় তাঁকেও অব্যাহতি দেয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
এদিকে আরও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রিয়া সাহা বর্তমানে আমেরিকায় বসেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপপ্রয়াসে তার এনজিও সংস্থার উপ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইভা পালের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় তথাকথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর সংগ্রহ করছেন। যে খবর আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী ইহুদি বংশোদ্ভূত রিচার্ড বেংকিনকে সাপ্লাই দেয়া হয় এবং তার মাধ্যমে বিভিন্ন মানবাধিকার জার্নালে তা প্রকাশিত হয়।
আর যে কারনে তার এই সংস্থায় কোন মুসলমান বা অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে চাকরী দেয়া হয়না। একমাত্র এমদাদুল হক নামে এক ব্যাক্তি ছিলেন। তাকেও এই কারনে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
শারি সংস্থার একটি পত্রিকা এবং অনলাইন ‘দলিত কন্ঠ’ প্রিয়া সাহার নামে প্রকাশক ও সম্পাদক থাকলেও তিনি আমেরিকায় আত্মগোপন থাকায় তা অবৈধ হওয়ার পরেও বর্তমানে সেটি প্রকাশ করে যাচ্ছে। জানা গেছে প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স এ্যাক্টের ৭ ধারা অনুযায়ী কোন পত্রিকা কিংবা অনলাইন এর প্রকাশক ও সম্পাদক যদি ৬ মাস সময় পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে হবে, আর ৬ মাসের অধিক সময় হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিতে হবে। যার কোনটিই না নিয়ে প্রিয়া সাহা ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে আমেরিকায় আত্মগোপনে রয়েছেন। তার ফেসবুক আইডি থেকে জানা গেছে, তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন এবং ঢাকা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।
এতেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি বর্তমানে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংস্থার অর্থ বিভাগের প্রধান প্রদীপ চন্দ্র দাস এর পাঠানো অর্থ দিয়েই নাকি আমেরিকার টেক্সাসে প্রিয়া সাহা বাড়ি কিনেছেন। দুর্নীতি দমন বিভাগ সঠিক অনুসন্ধান করলেই মূল বিষয়টি বেরিয়ে আসবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।