দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি বাজেট পেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৮ এএম, ৪ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৩২ পিএম, ২ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
জাতীয় সংসদে আজ বৃহস্পতিবার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট (প্রস্তাবিত) উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি বাজেট এটি। রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগামী বছরের বাজেট পেশ করছেন। এটি অর্থমন্ত্রীর জন্য তৃতীয় বাজেট। নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর পেশ করা এই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ (অনুদানসহ) ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা এবং অনুদান ছাড়া ঘাটতি হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক এক শতাংশ। আগামী বাজেটে ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক খাত থেকে নেয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার এক কোটি টাকা। পাশাপাশি ঋণ করার কারণে এর বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য আগামী অর্থবছরে সুদ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টায় বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এর আগে দুপুরে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এর অনুমোদন দেয়া হয়। দুপুর ১২টায় জাতীয়সংসদ ভবনের পশ্চিম ব্লকের দ্বিতীয়তলায় অবস্থিত মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এতে অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেন।
পরে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে খয়েরি ব্রিফকেস হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই ব্রিফকেসেই রয়েছে আগামী ২০২১-২০২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেট। এ সময় তার পরনে ছিল সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি, ওপরে কালো মুজিব কোট। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সংসদে প্রবেশ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে কম সংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে দেশের ৫০তম বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যারা উপস্থিত রয়েছেন তাদের মানতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি।
এবারের বাজেটে প্রাধিকার পেয়েছে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এবারের বাজেটটি করা হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে। বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের বাস্তবায়ন, কৃষিখাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থবছরের পুরো সময় জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বাড়ানো হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
বাজেট উপস্থাপনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কোভিড-১৯-এর দীর্ঘতর প্রভাব এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট ক্ষতি পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এবং বিশেষভাবে স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভূত প্রয়োজন মেটানো এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়াটি বিবেচনায় নিয়ে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ও বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যবস্থা প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে।
খাতভিত্তিক বরাদ্দ : বার্ষিক উন্নয়ান কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেয়াার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়াা হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মানবসম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৯.৪ শতাংশ, সার্বিক কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী উন্নয়ান ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২১.৭ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১২.১ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে (সড়ক, রেল, সেতু এবং যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২৬.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১০.৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি : ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এই হার গত বাজেটে ছিল ৬.১ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়ানে বৈদেশিক উৎস হতে এক লাখ এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সংগৃহীত হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়াপত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত হতে আসবে ৩৭ হাজার এক কোটি টাকা।
ব্যয় কাঠামো : বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্পাদিত কাজের শ্রেণি বিন্যাস অনুযায়াী কাজগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়া। সেগুলো হলো- সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো ও সাধারণ সেবা খাত। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৮.২৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বা ২৯.৭৬ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ান খাতে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৬৯ হাজার ৪৭৪ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।
সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৪.০৪ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়াতা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫.৭৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৩৬ শতাংশ; নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয়খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ০.৮৫ শতাংশ।
মধ্যমেয়াাদি নীতি-কৌশল : বিগত এক দশকে বাংলাদেশের ক্রমাগত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড-১৯-এর প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে করোনাভাইরাসের কারণে তা হ্রাস পেয়ে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কোভিড-১৯-এর প্রভাব হতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল আট দশমিক ২০ শতাংশ।
কিন্তু এ মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবং পুনরায় লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনেতিক কর্মকান্ডে শ্লথ অবস্থা বিরাজমান এবং রফতানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত গতি ফিরে পায়ানি। তবে প্রবাসী আয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত বৃহৎ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ানের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সংশোধন করে ছয় দশমিক এক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি কোভিড-১৯ পরবর্তী উত্তরণের বিষয়াটি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াাদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মধ্য মেয়াাদে প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হলো- শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। অন্যদিকে সরবরাহের দিক থেকে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে।
টাকা আসবে কোথা থেকে, খরচ হবে কোথায়?
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের এই অর্থ জোগান দিতে রাজস্ব, অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণের শরণাপন্ন হবে সরকার। এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা।
বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদন হয়েছে এডিপি।
এদিকে বাজেটে অনুদান ব্যতীত ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.১ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
যেখানে খরচ হবে : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক বরাদ্দ খাতে ব্যয় হবে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা বাজেটের ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এর মধ্যে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে খরচ হবে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৬৯ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
সাধারণ সেবা খাতে খরচের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, বিভিন্ন শিল্পে ভতুর্কি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধ বাবদ ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা ও নিট ঋণদান ৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
করোনা : জরুরি প্রয়োজনে রাখা হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকা
আগামী অর্থবছরেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য পুনরায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, বিগত বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল বরাদ্দ রেখেছিলাম। এ ছাড়া, যেকোনও জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছিলাম।
করোনা প্রাদুর্ভাবের বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী অব্যাহত মহামারির ভয়াবহ প্রকোপের কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি বিগত বাজেটের মতো এবারও অঙ্গীকার করছি, এ মহামারি মোকাবিলায় যা করণীয় তার সবকিছুই সরকার করে যাবে। সে কারণে আগামী অর্থবছরেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য পুনরায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত : প্রস্তাবিত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই তিন লাখ টাকা রাখা হয়েছে। অন্যদিকে নারী ও ৬৫ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের করদাতার সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের জন্যও করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার উপস্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়ের সাধারণ সীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।
প্রস্তাবিত বাজেটে করের হারের বিষয়ে বলা হয়েছে, সাধারণ করহারের মধ্যে প্রথম ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয় করমুক্ত থাকবে। পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা রয়েছে। নারী ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত থাকতে। একই সাথে সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ ও সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধাণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ : এবারের এই বাজেট হচ্ছে জিডিপির মাত্র ১৭.৪৬ শতাংশ। ২০২১ অর্থবছরের জন্য মূল বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ১৭.৯০ শতাংশ। এ হিসাবে বাজেটের প্রকৃত আকার বৃদ্ধির পরিবর্তে সংকোচিত হচ্ছে। এর পরেও বাজেট বাস্তবায়ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে মূল বাজেটের বাস্তবায়ন ব্যয় বৃদ্ধির পরিবর্তে আগের বছরের চেয়ে ৮.৫৩ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতায় সংশোধিত বাজেটের ব্যয় অবশ্য হ্রাস করে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা করা হয়েছে।
করোনার কঠিন পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলা হচ্ছে আগামী বাজেটে প্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির পালে কিছুটা হাওয়ার জন্য ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। কিছু খাতে দেয়া হচ্ছে কর অবকাশ সুবিধা। কমানো হচ্ছে, পুঁজিবাজারে নেই এমন কোম্পানির কর্পোরেট কর হারও।
এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন, কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অর্থবছরের পুরো সময় জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বাড়ানো হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যার আকার এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এখানে বলে রাখা ভালো-সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও প্রাইমারি স্কুল শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকাও রয়েছে।
শুধু তাই নয়, এবারই প্রথম নিরাপত্তামূলক নতুন এক তহবিল গঠনের প্রস্তাব থাকছে বাজেটে; যার নামকরণ করা হয়েছে ‘অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতি অভিঘাত মোকাবিলা তহবিল’। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি বাজেট বক্তৃতার শুরুর দিকে থাকবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন অগ্রগতির গুণকীর্তন এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের নানা চিত্র। এরপর থাকবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের একটি চিত্র। তারপর দেয়া হবে আগামী অর্থবছরের ব্যয় বা বাজেটের আকার ও ব্যয় বরাদ্দের চিত্র।
এদিকে বাজেটকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে বাজেটের সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারছেন। দেশ-বিদেশ থেকে ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে। প্রাপ্ত সব মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময় এবং পরে তা কার্যকর করা হবে।